বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে আজ এক গভীর সংকট দৃশ্যমান। এটি কোনো হঠাৎ, অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়; বরং দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল করার একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা। গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে থাকে যুক্তি, ন্যায়বোধ ও ইনসাফের ওপর। আবেগ, প্রতিহিংসা ও অর্ধসত্যকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো মানেই রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়া। এই বাস্তবতায় নাগরিকদের দায়িত্ব কেবল ভোটাধিকারে সীমাবদ্ধ নয়; তাদের দায়িত্ব হলো প্রজ্ঞা, নৈতিক শক্তি ও সচেতনতা দিয়ে রাষ্ট্রকে সঠিক পথে রাখা।
ইতিহাস আমাদের শেখায়, স্বাধীনতার সংগ্রামের সময় ভারতের ভূমিকা সবসময় বাংলাদেশের স্বার্থের সঙ্গে সমন্বিত ছিল না। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীসহ জাতীয় নেতাদের অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রমাণ করে, ভারতের নীতি সবসময় আমাদের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এটি শুধুমাত্র অতীত নয়; বর্তমানেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ভারতবিরোধিতা কোনো আবেগপূর্ণ জাতীয়তাবাদ নয়, এটি একটি প্রগতিশীল, জ্ঞানভিত্তিক প্রতিরক্ষা নীতি, যা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র বীর হাদির বক্তব্য এই বাস্তবতার প্রতিফলন। তিনি কোথাও উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার করেননি; বরং স্পষ্ট ও দায়িত্বশীল কণ্ঠে ন্যায়বিচার, ইনসাফ এবং দায়িত্বশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। বীর হাদি কখনোই নির্বিচার আক্রমণ বা সহিংসতার আহ্বান করেননি। তাঁর দর্শন স্পষ্ট: অপরাধী অপরাধের জন্য জবাবদিহি দেবে, কিন্তু নিরপরাধ কোনো নাগরিক রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক সহিংসতার শিকার হবে না।
শত্রুতা ব্যক্তির সঙ্গে নয়, শত্রুতা অন্যায়ের সঙ্গে। যারা এই মৌলিক পার্থক্য মুছে দিতে চায়, তারা আসলে আইন ও ন্যায়বিচারকে অকার্যকর করে প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হলে দুর্নীতি, লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয় সংকুচিত হয়। এই ভয় থেকেই ইনকিলাবের ধারণা বিকৃত করা হয় এবং সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চলে।
রাজনীতির নয়া বন্দোবস্তের দাবি কোনো হঠাৎ স্লোগান নয়; এটি সময়ের অনিবার্য প্রয়োজন। একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা মানে কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা, পেশাদারিত্ব এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা। আইন সকলের জন্য সমান—এই নীতি যদি কার্যকর না হয়, রাষ্ট্র তার নৈতিক কর্তৃত্ব হারায়। অধিকার সকলের জন্য সমান যদি দলীয় পরিচয়, মতাদর্শ বা ক্ষমতার নৈকট্যের ওপর নির্ভর করে, তবে নাগরিকত্বের ধারণাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বৈষম্যহীনতা কোনো অনুগ্রহ নয়; এটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার।
গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি রাষ্ট্রের শত্রু নয়; বরং এগুলো রাষ্ট্রের বিবেক। প্রশ্ন তোলা, সমালোচনা করা, বিকল্প মত প্রকাশ করা এবং ক্ষমতার অন্ধকার দিক উন্মোচন করাই তাদের মৌলিক দায়িত্ব। যখন সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক কিংবা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে হুমকি দেওয়া হয়, তখন স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশের ওপর সরাসরি আঘাত আসে। এতে দেশপ্রেম শক্তিশালী হয় না; বরং জন্ম নেয় সংকীর্ণতা, ভয় ও উগ্রতা। প্রকৃত দেশপ্রেম মানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তুলে ধরা নয়, বরং তাদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে আরও শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল করা।
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। সার্বভৌমত্ব কেবল সীমান্ত রক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ভিন্নমতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই একটি পরিণত রাষ্ট্রের পরিচয়। রাষ্ট্র যখন নিরপেক্ষ থাকে এবং আইনকে দলীয় হাতিয়ার বানায় না, তখন নাগরিকরা নিরাপদ বোধ করে। পক্ষপাতদুষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত সমাজে বিভাজন, অবিশ্বাস এবং স্থায়ী অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা, দুর্নীতি ও ভণ্ডামি—এই চারটি ব্যাধি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের রাষ্ট্রজীবনকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এগুলো থেকে মুক্তি না পেলে শহীদদের আত্মত্যাগ অর্থহীন হবে। শহীদদের রক্ত কোনো দলের সম্পত্তি নয়; এটি ন্যায়, গণতন্ত্র এবং মানবিক রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গীকার। শহীদদের স্মরণ মানে প্রতিশোধ নয়, সংস্কার। আবেগ নয়, দায়িত্ব। রাষ্ট্র যদি শহীদের স্মৃতিকে বিভাজনের রাজনীতিতে ব্যবহার করে, তবে সেই স্মৃতিই একদিন রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
ইনকিলাবের ধারণা কখনোই সহিংসতার প্রতিশব্দ হতে পারে না। এটি ইতিহাসকে বিকৃত করার অপচেষ্টা। ইনকিলাব মানে অন্যায়ের কাঠামো ভেঙে, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এটি কোনো তাৎক্ষণিক ঘটনা নয়; এটি ধীর, প্রজ্ঞাসম্পন্ন এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এখানে স্লোগানের চেয়ে নীতির মূল্য বেশি; উত্তেজনার চেয়ে সংযম জরুরি। রাষ্ট্র যদি ন্যায়বিচারের পথে দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হয়, নাগরিকদের হাতে আইন তুলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না—এটাই ইনসাফের রাজনীতির মূল দর্শন।
বর্তমান বিশ্বে ভারতের আধিপত্য এবং প্রভাবশালী নীতি আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু আবেগ দিয়ে কোনো প্রতিবাদ কার্যকর হয় না। ভারতকে প্রতিহত করতে হবে জ্ঞান, মেধা, বুদ্ধি, আবিষ্কার, প্রযুক্তি, অর্থ এবং সামাজিক সমৃদ্ধি দিয়ে। আমাদের শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং কূটনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে। ভারতের আধিপত্য মোকাবিলা করার জন্য আমাদের শিক্ষিত, সচেতন, নৈতিক ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করতে হবে।
শুধু রাষ্ট্র নয়, নাগরিকদেরও দায়িত্ব বেড়ে যায়। আমাদের উচিত তথ্যভিত্তিক যুক্তি, দায়িত্বশীল সমালোচনা এবং সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের শক্তি বৃদ্ধি করা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনা বা আবেগের রাজনীতি জাতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। দেশের শত্রু কে এবং কাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নির্ধারণ করা উচিত—শুধু সীমান্তে নয়, বুদ্ধি, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির মাঠেও।
গণমাধ্যম এবং সংস্কৃতি রাষ্ট্রের বিবেক। দায়িত্বশীল সংবাদ, সাহিত্যে সততা, শিল্পকলার স্বচ্ছতা—এগুলোই সমাজে ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও দায়িত্ববোধকে প্রতিষ্ঠিত করে। ভারতবিরোধী আবেগকে কৌশলগত পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করলে নাগরিক সমাজ বিভ্রান্ত হয়। প্রকৃত দেশপ্রেম মানে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ নয়; বরং দেশের প্রতিষ্ঠান, মানুষ এবং সাংস্কৃতিক শক্তিকে শক্তিশালী করা।
আজ আমাদের প্রয়োজন একটি পরিণত নাগরিক সমাজ। যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্তেজনা নয়, বরং তথ্যভিত্তিক যুক্তি, দায়িত্বশীল আলোচনা এবং সমালোচনার পরিবেশ থাকবে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হয় কূটনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে। শত্রু খুঁজে রাজনীতি করা সহজ, কিন্তু রাষ্ট্র গঠন কঠিন। সেই কঠিন পথই আমাদের বেছে নিতে হবে।
সবশেষে, নাগরিকদের কাছে প্রশ্নটি একটাই—আমরা কি আবেগের রাজনীতিতে ভেসে যাব, নাকি ন্যায়বিচার, ইনসাফ এবং জ্ঞানভিত্তিক শক্তির রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করব? আমরা কি বিভাজনের ভাষা বেছে নেব, নাকি একটি মানবিক, ভারসাম্যপূর্ণ এবং শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ার পথে এগোব?
দেশকে ভালোবাসা মানে মাকে ভালোবাসার মতো নীরব দায়িত্ব নেওয়া। আগামীর বাংলাদেশ হোক এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে আইন, অধিকার এবং ভিন্নমত সবার জন্য সমান, যেখানে ন্যায়বিচার নির্ভরযোগ্য, রাষ্ট্রের শক্তি আসে নৈতিকতা ও জ্ঞানের ভিত্তিতে, এবং নাগরিকরা সম্মিলিত দায়িত্বে এগিয়ে আসে। এই স্বপ্ন কোনো একক ব্যক্তির নয়। এটি আমাদের সবার সম্মিলিত অঙ্গীকার।
কলামিস্ট ও সংগঠক
