রাষ্ট্র সব সময় বন্দুকের নল দিয়ে ধ্বংস হয় না। অনেক সময় রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে হাততালির শব্দে। অতিরিক্ত প্রশংসা, নিরবচ্ছিন্ন তোষামোদ আর প্রশ্নহীন আনুগত্য—এই তিনটি উপাদান যখন ক্ষমতার চারপাশে দেয়াল তুলে দেয়, তখন রাষ্ট্র ধীরে ধীরে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই বিচ্ছিন্নতার নাম চাটুকারিতা—একটি নীরব কিন্তু মারাত্মক ব্যাধি, যা রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে ক্ষয় করছে।

চাটুকারিতা কোনো সৌজন্য নয়, এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল। এখানে সত্যের প্রয়োজন নেই, যুক্তির দরকার নেই, বিবেকের ভূমিকা নেই। প্রয়োজন শুধু ক্ষমতার মন রক্ষা করা। ফলে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় বাস্তবতার আলোকে নয়, বরং প্রশংসার প্রতিধ্বনিতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হান্না আরেন্ট একে বলেছিলেন “সংগঠিত আত্মপ্রবঞ্চনা”— যেখানে শাসকগোষ্ঠী নিজেরাই নিজেদের বানানো মিথ্যার জগতে বসবাস করতে শুরু করে। বাংলাদেশের ক্ষমতার বলয়ে তাকালেই এই আত্মপ্রবঞ্চনার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট।

চাটুকারিতা আনুগত্য নয়; এটি নৈতিক পরাজয়ের প্রকাশ। আনুগত্যের ভিত্তি যদি নীতি হয়, তবে তা রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে। কিন্তু আনুগত্য যদি সুবিধার ওপর দাঁড়ায়, তবে তা রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ আনুগত্য মানে প্রশ্ন না করা, ভুলকে ভুল না বলা, আর ব্যর্থতাকে সাফল্য হিসেবে প্রচার করা। ইতিহাসবিদ টিমোথি স্নাইডার সতর্ক করেছিলেন—যখন সত্য বলার মানুষ হারিয়ে যায়, তখন স্বৈরতন্ত্রের জন্য আলাদা করে ষড়যন্ত্র করতে হয় না; পরিবেশ নিজেই তাকে জন্ম দেয়।

এই চাটুকারিতার রাজনীতি এখন আর শুধু রাজনৈতিক মঞ্চে সীমাবদ্ধ নয়। এটি পেশাকে গ্রাস করেছে, প্রতিষ্ঠানকে দলীয় বানিয়েছে, আর বিবেককে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। শিক্ষক আজ পাঠদানের চেয়ে দলীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে বেশি আগ্রহী। চিকিৎসক রোগীর আগে রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করেন। সাংবাদিক সত্যের চেয়ে ক্ষমতার ভাষ্যকে নিরাপদ মনে করেন। পেশা তখন আর সেবা থাকে না, হয়ে ওঠে আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যম। দার্শনিক জন রলস বলেছিলেন, ন্যায্য সমাজে প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির রাজনৈতিক মতের ঊর্ধ্বে থাকে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠানই রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে, আর ন্যায়বিচার হয়ে গেছে ঐচ্ছিক।

সরকারি প্রশাসনে চাটুকারিতা রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ নেয়। প্রশাসন হওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রের স্নায়ুতন্ত্র, কিন্তু এখন অনেক ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠেছে ক্ষমতার প্রশংসা বিভাগ। সমস্যা পুরোটা বলা হয় না, তথ্য ছাঁকনি দিয়ে ওপরে যায়, বাস্তবতা সাজানো ভাষায় উপস্থাপিত হয়। কারণ সত্য বলা মানে ঝুঁকি নেওয়া। আর চাটুকার সমাজ ঝুঁকিকে পছন্দ করে না। দাগ হ্যামারশোল্ড বলেছিলেন, একজন সৎ আমলার দায়িত্ব হলো সত্য বলা—বাবহ যিবহ রঃ রং রহপড়হাবহরবহঃ। কিন্তু অসুবিধা এড়াতে গিয়ে প্রশাসন যখন সত্য গোপন করে, তখন সিদ্ধান্তও ভুল পথে যায়।

গণতন্ত্রে সাংবাদিকতা পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে। কিন্তু চাটুকারিতার সংস্কৃতি সাংবাদিকতার মধ্যেও গভীরভাবে ঢুকে পড়েছে। প্রশ্নহীন সংবাদ, একমুখী বিশ্লেষণ, সমালোচনার বদলে প্রশংসার পুনরাবৃত্তি নাগরিকদের বিভ্রান্ত করে। আই এফ স্টোন বলেছিলেন, সব সরকারই মিথ্যা বলে; সাংবাদিকতার কাজ সেই মিথ্যা ধরিয়ে দেওয়া। যখন সাংবাদিকতা সেই দায়িত্ব থেকে সরে আসে, তখন গণতন্ত্র অন্ধ হয়ে পড়ে—আর অন্ধ গণতন্ত্র বেশিদিন টেকে না।

অর্থনীতি ও ব্যবসায় চাটুকারিতার প্রভাব আরও নির্মম। রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা যদি ব্যবসার লাইসেন্স হয়ে দাঁড়ায়, তবে প্রতিযোগিতা নয়, সিন্ডিকেটই বাজার শাসন করে। যোগ্যতা নয়, সম্পর্ক তখন মূলধন। অ্যাডাম স্মিথ বহু আগেই সতর্ক করেছিলেন—রাষ্ট্র যখন কিছু ব্যবসায়ীর পক্ষ নেয়, তখন বাজার নয়, লোভ শাসন করে। আমাদের বাস্তবতায় এই লোভের দাম দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসও এক নির্মম সত্য শেখায়—চাটুকারিতাই বারবার ক্ষমতার পতনের পথ তৈরি করেছে। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মানুষরা যখন কেবল প্রশংসা শোনেন, তখন তারা জনমত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। রাজনৈতিক ইতিহাসবিদেরা একে বলেন ক্ষমতার আত্মতুষ্টি। নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষায়, যে মানুষ কেবল প্রশংসা শোনে, সে নিজের দুর্বলতা দেখতে পায় না। আর যে নেতৃত্ব নিজের দুর্বলতা দেখতে পায় না, তার পতন ইতিহাসের নিয়ম।

এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন আমাদের সামনে দাঁড়ায়। একজন শিক্ষক কেন রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত হবেন? একজন চিকিৎসক কেন দলীয় আনুগত্য দিয়ে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করবেন? রাজনৈতিক মত থাকা নাগরিক অধিকার, কিন্তু পেশাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, মানুষের পরিচয় তার কাজে, তার নৈতিকতায়। পেশার মাধ্যমে মানুষের সেবা করাই প্রকৃত দেশপ্রেম—পোস্টার লাগানো বা জন্মদিনের কেক কাটায় নয়।

রাজনীতি সমাজের জন্য অপরিহার্য, কিন্তু সবকিছুতে রাজনীতির অনুপ্রবেশ সমাজকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। রাজনীতিবিদদের কাজ রাজনীতি করা, নীতি নির্ধারণ করা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন সমাজের অন্যান্য পেশাজীবীরা তোষামোদিকে পেশা বানায়, তখন রাজনীতিও বিকৃত হয়। ম্যাক্স ওয়েবারের ভাষায়, রাজনীতি কখনোই নৈতিকতার বিকল্প হতে পারে না। নৈতিকতা ছাড়া রাজনীতি শেষ পর্যন্ত নিজের ওজনেই ভেঙে পড়ে।

এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন এখন বিলাসিতা নয়, এটি জরুরি প্রয়োজন। আইনি সংস্কার দরকার, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার নৈতিক সংস্কার। নাগরিকদের বুঝতে হবে—ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে আদর্শ বদলানো কোনো বাস্তববাদ নয়, এটি আত্মসম্মান বিসর্জন। রাষ্ট্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন নাগরিকেরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সত্য বলার সাহস রাখে।

সবশেষে স্পষ্ট করে বলা দরকার—চাটুকারিতার রাজনীতি রাষ্ট্র গড়ে না, রাষ্ট্র ভাঙে। নেতা নয়, নীতি গুরুত্বপূর্ণ। দল নয়, দেশ গুরুত্বপূর্ণ। পেশা নয়, বিবেক বিসর্জন দেওয়া আত্মঘাতী। রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করতে দিন, কিন্তু তোষামোদির মাধ্যমে তাদের দেবতা বানাবেন না। কারণ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—দেবতা বানানো নেতারা শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে দ্রুত ভেঙে পড়েন। সত্য, দায়িত্ব ও পেশাগত নৈতিকতার পথেই রয়েছে বাংলাদেশের টেকসই ভবিষ্যৎ।

লেখক ও সংগঠক